কুরবানীর পরিচয়,ইতিহাস ও হুকুম - মেঘনার খবর
মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ২ আশ্বিন ১৪৩১

কুরবানীর পরিচয়,ইতিহাস ও হুকুম

মহান আল্লাহ মানব জাতিকে একমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। তবে সেক্ষেত্রে তিনি কিছু ইবাদত ফরজ করেছেন, আর কিছুকে করেছেন ওয়াজিব। মুসলিমগণের কর্তব্য একনিষ্ঠভাবে একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সেগুলো সম্পন্ন করা। কুরবানী সে ধরনের একটি ইবাদত যার বিধান আদম (আ.) এর যুগ থেকেই চলে আসছে। কিন্তু এ গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের সঠিক ইতিহাস ও বিধানাবলী সম্পর্কে আমরা খুব কমই অবগত আছি। আলোচ্য নিবন্ধটি এ বিষয়ে আমাদের অনেক সহায়ক হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
কুরবানীর শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ:-
কুরবানী শব্দটি আরবী قربان  (কুরবান) হতে উৎপন্ন। যার অর্থ হল, নিকটবর্তী হওয়া বা নৈকট্য লাভ করা। আর শরীয়তের পরিভাষায়, কুরবানী বলতে যে পশু ঈদের দিন জবেহ করা হয় তাকেই বুঝানো হয়। এটাকে আবরীতে أضحية (উযহিয়া)ও বলা হয়। এই أضحية আরবী শব্দটিকে চার ভাবে পড়া যায়।
(১) أضحية (উযহিয়্যাহ)
(২) إضحية (ইযহিয়্যাহ) এ দুটি শব্দের বহুবচন আসে أضاحي)
(৩) ضحية (যহিয়্যাহ্) বহুবচনেঃ ضحايا যাহায়া
(৪) أضحاه (আযহাহুন) বহু বচনেঃ أضحى  এ থেকে কুরবানীর দিন কে আরবী ভাষায় يوم الأضحي (ইয়ামুল আযহা) বলা হয়। (লেসানুল আরাবের বরাতে ফিকহুল উযহিয়্যাহ ৭ পৃঃ)
ইমাম ছানআনী বলেন: কুরবানীকে আরবী পরিভাষা বলা হয়, أضاحي আযাহী যা أضحية শব্দের বহুবচন। আর এই শব্দটির হামযায় যের দিয়েও পড়া যায় আবার হামযা বাদ দিয়ে ض এ যবর দিয়ে (ضحية)ও পড়া যায়। (এর শাব্দিক অর্থ অপরাহ্ন) ইহা যেন সে সময়ের নাম থেকেই নেয়া হয়েছে যে সময় উক্ত কুরবানীর পশুকে যবেহ করা বিধেয়। (আর তা হল, অপরাহ্নে) (সুবুলু সালামের (৪/১৬০) এর বরাতে ফিকহুল উযহিয়্যাহ্ঃ ৭)
কুরবানীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
কুরবানীর বিধানটি অতীব প্রাচীন বিধান। আল্লাহ বলেন: ﴿وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا﴾ “আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানীর ব্যবস্থা করেছি।” ( সূরা হাজ্জঃ ৩৪)
আদম (আঃ) এর দুই পুত্র হাবীল ও কাবীলের দেয়া কুরবানী থেকেই কুরবানীর ইতিহাসের গোড়া পত্তন হয়েছে। আল্লাহ বলেন:
وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آَدَمَ بِالْحَقِّ إِذْ قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنْ أَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنَ الْآَخَرِ قَالَ لَأَقْتُلَنَّكَ قَالَ إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ لَئِنْ بَسَطْتَ إِلَيَّ يَدَكَ لِتَقْتُلَنِي مَا أَنَا بِبَاسِطٍ يَدِيَ إِلَيْكَ لِأَقْتُلَكَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ إِنِّي أُرِيدُ أَنْ تَبُوءَ بِإِثْمِي وَإِثْمِكَ فَتَكُونَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ
অর্থাৎ“(হে রাসূল!) আপনি তাদেরকে সঠিক ভাবে পড়ে শুনিয়ে দিন আদমের পুত্রদ্বয়ের সংবাদ। যখন তারা কুরবানী দিল কিন্তু তাদের একজনেরটা গৃহীত হল অপরেরটা গৃহীত হল না। তখন (যার কুরবানী গৃহীত হলনা সে যার কুরবান গৃহীত হল তাকে লক্ষ্য করে) বলল, আমি তোমাকে হত্যা করব। (উত্তরে) সে বলল, আল্লাহ তো শুধু পরহেজগারদের থেকেই (কুরবানী) কবুল করেন। আমাকে হত্যা করার জন্য তুমি হাত প্রসারিত করলেও আমি তোমাকে হত্যা করার জন্য আপন হাত প্রসার করবনা। আমি চাই তুমি আমার গুনাহ এবং তোমার গুনাহ বহন করে জাহান্নামীদের দলভুক্ত হও”। (সূরা মায়েদাহঃ ২৭,২৮ ও ২৯)
মূল ঘটনা হলো:-
যখন আদম ও হাওয়া (আ.) পৃথিবীতে আগমন করেন এবং তাদের সন্তান প্রজনন ও বংশ বিস্তার আরম্ভ হয়, তখন হাওয়া (আ.) এর প্রতি গর্ভ থেকে জোড়া জোড়া (জময) অর্থাৎ একসাথে একটি পুত্র ও একটি কন্যা এরূপ জময সন্তান জন্মগ্রহণ করত। কেবল শীস (আ.) ব্যতিরেকে। কারণ, তিনি একা ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। তখন ভাই-বোন ছাড়া আদম (আ.) এর আর কোন সন্তান ছিল না। অথচ ভাই-বোন পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে না। তাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা উপস্থিত প্রয়োজনের খাতিরে আদম (আ.) এর শরীয়তে বিশেষভাবে এ নির্দেশ জারি করেন যে, একই গর্ভ থেকে যে যমজ পুত্র ও কন্যা জন্মগ্রহণ করবে, তারা পরস্পর সহোদর ভাই-বোন হিসেবে গণ্য হবে। তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম। কিন্তু পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্মগ্রহনকারী পুত্রের জন্য প্রথম গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণকারীনি কন্যা সহোদরা বোন হিসেবে গণ্য হবে না। তাদের মধ্যে পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ।
সুতরাং সে সময় আদম (আ.) একটি জোড়ার মেয়ের সাথে অন্য জোড়ার ছেলের বিয়ে দিতেন। ঘটনাক্রমে কাবীলের সাথে যে সহোদরা জন্ম নিয়েছিল সে ছিল পরমা সুন্দরী। তার নাম ছিল আকলিমা। কিন্তু হাবিলের সাথে যে সহোদরা জন্ম নিয়েছিল সে দেখতে অতটা সুন্দরী ছিল না। তার নাম ছিল লিওযা। বিবাহের সময় হলে শরয়ী ‘নিয়মানুযায়ী হাবীলের সহোদরা  বোন লিওযা কাবীলের ভাগে পড়ল।
কাবিল তাতে আপত্তি করল। ফলে আদম (আ.) তৎকালীন শরীয়তের আইনের পরিপ্রেক্ষি তে কাবীলের আবদার প্রত্যাখ্যান করলেন এবং তাকে তার নির্দেশ মানতে বললেন। কিন্তু সে মানল না। এবার তিনি তাকে বকাঝকা করলেন। তবুও সে ঐ বকাঝকায় কান দিল না। অবশেষে আদম (আ.) তার এ দু‘সন্তান হাবীল ও কাবীলের মতভেদ দূর করার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তোমরা উভয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে কুরবানী পেশ কর, যার কুরবানী গৃহীত হবে, তার সাথেই আকলিমার বিয়ে দেয়া হবে।’ সে সময় কুরবানী গৃহীত হওয়ার একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল যে, আকাশ থেকে একটি অগ্নিশিখা এসে সে কুরবানীকে ভষ্মীভূত করে ফেলত। আর যার কুরবানী কবূল হতো না তারটা পড়ে থকত।
যা-হোক, তাদের কুরবানীর পদ্ধতি সম্পর্কে যা জানা যায় তা হলো- কাবীল ছিল চাষী। তাই তিনি গমের শীষ থেকে ভাল ভাল মালগুলো বের করে নিয়ে বাজে মালগুলোর একটি আটি কুরবানীর জন্য পেশ করল। আর হাবীল ছিল পশুপালনকারী। তাই সে তার জন্তুর মধ্যে থেকে সবচেয়ে সেরা একটি দুম্বা কুরবানীর জন্য পেশ করল। এরপর নিয়মানুযায়ী আকাশ থেকে অগ্নিশিখা এসে হাবীলের কুরবানীটি ভষ্মীভুত করে দিল। [ফতহুল ক্বাদীরের বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, হাবীলের পেশকৃত দুম্বাটি জান্নাতে উঠিয়ে নেয়া হয় এবং তা জান্নাতে বিচরণ করতে থাকে। অবশেষে ইসমাঈল যাবিহুল্লাহ (আ.) কে ঐ দুম্বাটি পাঠিয়ে বাঁচিয়ে দেয়া হয়।] আর কাবীলের কুরবানী যথাস্থানেই পড়ে থাকল। অর্থাৎ হাবীলেরটি গৃহীত হলো আর কাবীলেরটি হলো না। কিন্তু কাবীল এ আসমানী সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারল না। এ অকৃতকার্যতায় কাবীলের দুঃখ ও ক্ষোভ আরো বেড়ে গেল। সে আত্মসংবরণ করতে পারল না এবং প্রকাশ্যে তার ভাইকে বলল, ‘আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব। হাবিল তখন ক্রোধের জবাবে ক্রোধ প্রদর্শন না করে একটি মার্জিত ও নীতিগত বাক্য উচ্চারণ করল, এতে কাবীলের প্রতি তার সহানুভূতি ও শুভেচ্ছা ফুটে উঠেছিল। হাবীল বলেছিল, ‘ তিনি মুত্তাক্বীর কর্মই গ্রহণ করেন।সুতরাং তুমি তাক্বওয়ার কর্মই গ্রহণ করো। তুমি তাক্বওয়া অবলম্বন করলে তোমার কুরবানীও গৃহীত হতো। তুমি তা করোনি, তাই তোমার কুরবানী প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এতে আমার দোষ কোথায়?…..তবুও এক পর্যায়ে কাবীল হাবীল কে হত্যা করে ফেলল। (তাফসীর ইবনু কাসীর, দুররে মনসূর, ফতহুল বায়ান, ৩/৪৫ ও ফতহুল ক্বাদীর, ২/২৮-২৯)
কুরআনে বর্ণিত হাবীল ও কাবীল কর্তৃক সম্পাদিত কুরবানীর এ ঘটনা থেকেই মূলত কুরবানীর ইতিহাসের গোড়াপত্তন হয়েছে। এ ঘটনায় আমরা দেখতে পেলাম যে, কুরবানী দাতা ‘হাবীল’, যিনি মনের ঐকান্তিক আগ্রহ সহকারে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের জন্যে একটি সুন্দর দুম্বা কুরবানী হিসেবে পেশ করেন। ফলে তার কুরবানী কবূল হয়। পক্ষান্তরে কাবীল, সে অমনোযোগী অবস্থায় কিছু খাদ্যশস্য কুরবানী হিসেবে পেশ করে। ফলে তার কুরবানী কবূল হয়নি। সুতরাং প্রমাণিত হলো কুরবানী মনের ঐকান্তিক আগ্রহ ছাড়া কবূল হয় না। তারপর থেকে বিগত সকল উম্মতের উপরে এটা জারি ছিল।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,- وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ فَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوا وَبَشِّرِ الْمُخْبِتِينَ
 অর্থাৎ প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কুরবানীর বিধান রেখেছিলাম, যাতে তারা উক্ত পশু যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করে এ জন্য যে, তিনি চতুষ্পদ জন্তু থেকে তাদের জন্য রিযিক নির্ধারণ করেছেন। [সূরা হাজ্জ (২২):৩৪]।
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা নাসাফী ও যামাখশারী বলেন, ‘আদম (আ.) থেকে মুহাম্মাদ (সা.) পর্যন্ত প্রত্যেক জাতিকে আল্লাহ তা‘আলা তার নৈকট্য লাভের জন্য কুরবানীর বিধান দিয়েছেন। (তাফসীরে নাসাফী ৩/৭৯; কাশশাফ, ২/৩৩)।
আদম (আ.) এর যুগে তারই পুত্র কাবীল ও হাবীলের কুরবানীর পর থেকে ইবরাহীম (আ.) পর্যন্ত কুরবানী চলতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে কুরবানীর ইতিহার ততটা প্রাচীন যতটা প্রাচীন দ্বীন-ধর্ম অথবা মানবজাতির ইতিহার। মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে যত শরীয়ত নাযিল হয়েছে, প্রত্যেক শরীয়তের মধ্যে কুরবানী করার বিধান জারি ছিল। প্রত্যেক উম্মতের ইবাদতের এ ছিল একটা অপরিহার্য অংশ। তবে ঐসব কুরবানীর কোন বর্ণনা কোন গ্রন্থে পাওয়া যায় না। মূলত সেসব কুরবানীর নিয়ম-কানুন আমাদেরকে জানানো হয়নি। তবে আমাদের উপর যেভাবে কুরবানী বিধান রয়েছে তা ইবরাহিম (আঃ) এর কুরবানী থেকে এসেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন وَفَدَيۡنَٰهُ بِذِبۡحٍ عَظِيم আমি তাঁর (ইসমাইল) পরিবর্তে দিলাম যবেহ করার জন্যে এক মহান জন্ত। (সূরা সাফফাতঃ ১০৭)
বর্তমান কুরবানীর ইতিহাস :-
পবিএ কুরআনে এসেছে-
رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِينَ (100) فَبَشَّرْنَاهُ بِغُلَامٍ حَلِيمٍ (101) فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَاذَا تَرَى قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ (102) فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ (103) وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيمُ (104) قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ (105) إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلَاءُ الْمُبِينُ (106) وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ (107) وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآخِرِينَ (108) سَلَامٌ عَلَى إِبْرَاهِيمَ (109) كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ (110) إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُؤْمِنِينَ
    অর্থাৎ [ইব্রাহীম (আ.) যখন আমার কাছে দু‘আ করল] হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে এক সৎকর্মশীল পুত্র সন্তান দান কর। অতঃপর আমি তাকে এক অতি ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। অতঃপর সে যখন তার পিতার সাথে চলাফিরা করার বয়সে পৌঁছল, তখন ইবরাহীম বলল, ‘বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবেহ করছি, এখন বল, তোমার অভিমত কী? সে বলল, ‘হে পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তাই করুন, আল্লাহ চাইলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীলই পাবেন। দু‘জনেই যখন আনুগত্যে মাথা নুইয়ে দিল আর ইবরাহীম তাকে কাত ক‘রে শুইয়ে দিল। তখন আমি তাকে ডাক দিলাম, ‘হে ইবরাহীম! স্বপ্নে দেয়া আদেশ তুমি সত্যে পরিণত করেই ছাড়লে। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি। অবশ্যই এটা ছিল একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি এক মহান কুরবাণীর বিনিময়ে পুত্রটিকে ছাড়িয়ে নিলাম। আর আমি তাঁকে পরবর্তীদের মাঝে স্মরণীয় করে রাখলাম। ইবরাহীমের উপর শান্তি বর্ষিত হোক! সৎকর্মশীলদেরকে আমি এভাবেই প্রতিদান দিয়ে থাকি। সে ছিল আমার মু‘মিন বান্দাহদের অন্তর্ভুক্ত। [সূরা আস- সাফফাত:১০০-১১১]।
      ইবনে কাসীর (রাহ.) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা আমাদের জানান যে, তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইব্রাহীম (আ.) যখন তার পিতৃভুমি থেকে হিজরত করলেন, তখন তিনি তার প্রভুর কাছে চেয়েছিলেন যে, তিনি যেন তাকে সৎকর্মশীল সন্তান দান করেন। তাই আল্লাহ তা‘আলা তাকে একজন ধৈর্যশীল পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। এটা ছিল ইসমাঈলের (আ.) ব্যাপারে, কেননা তিনি ছিলেন ইব্রাহীমের (আ.) ঔরসে জন্ম নেয়া প্রথম সন্তান। এ ব্যাপারে বিভিন্ন দ্বীনের (ইহুদী, খ্রিস্টান ও মুসলিম) অনুসারীদের মধ্যে কোন মতভেদ নেই যে ইব্রাহীমের ঘরে ইসমাঈলই প্রথম জন্মগ্রহণ করেছিলেন। (ইবনে কাসীরের আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১/১৫৭-১৫৮)
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ ٱلسَّعۡيَ অর্থাৎ ‘এবং যখন সে তার সাথে হাটার মত বড় হলো’- এর অর্থ হচ্ছে, যখন সে বড় হয়েছিল এবং তার বাবার মতই নিজেই নিজের দেখাশোনা করতে পারত। মুজাহিদ (রাহ.) বলেন, ‘এবং যখন সে তার সাথে হাঁটার মত বড় হলো’ এর অর্থ হচ্ছে, যখন সে বড় হয়ে উঠেছিল এবং বাহনে চড়তে পারত, হাঁটতে পারত এবং তার বাবার মত কাজ করতে পারত। যবহের সময় ইসমাঈলের বয়স ছিল ১৩ বছর। ইবনু আববাস (রা.) বলেন, ঐ সময় তিনি কেবল সাবলকত্বে উপনীত হয়েছিলেন। (তাফসীর কুরতুবী, ১৫/৯৯) এ রকম একটা অবস্থা যখন আসল, তখন ইব্রাহীম (আ.) স্বপ্নে দেখলেন যে, তাঁকে তার ছেলেকে কুরবানী করার আদেশ দেয়া হচ্ছে। নবীদের স্বপ্ন হচ্ছে ওহী। তাদের চক্ষু মুদিত থাকলেও অন্তরচক্ষু খোলা থাকে।
      সুতরাং আল্লাহ তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে, তার প্রিয়পুত্রকে কুরবানী করার আদেশ দিয়ে পরীক্ষা করছিলেন, যে পুত্রকে তিনি তার বৃদ্ধাবস্থায় পেয়েছিলেন এবং তারপর শিশু অবস্থায় তাকে এবং তার মাকে মরুভুমিতে রেখে আসার আদেশ পেয়েছিলেন, এমন একটা উপত্যকায় যেখানে কোন জনপ্রাণীর সাড়াশব্দ ছিল না, কোন মানুষজন ছিল না, কোন বৃক্ষরাজি ছিল না এবং কোন পাখ-পাখালী বা পশুও ছিল না। ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর আদেশ পালন করলেন এবং আল্লাহর উপর ভরসা করে তাদের সেখানে রেখে আসলেন। আর আল্লাহ তাদের জন্য অপ্রত্যাশিত উৎস থেকে রিযিক পাঠালেন। এত কিছুর পরেও, তার ঘরে প্রথম জন্ম নেয়া ও তার একমাত্র পুত্রকে কুরবানী করার জন্য যখন আদেশ করা হলো, তিনি তখন তাঁর প্রভুর ডাকে সাড়া দিলেন এবং তার প্রভুর আদেশ মেনে, তিনি যা চেয়েছিলেন, তা করতে উদ্যত হলেন। তাই তিনি তার পুত্রকে ব্যাপারটা সম্বন্ধে বললেন-(যেন সে শান্ত থাকে এবং জোর করে তাকে কুরবানী করতে না হয়।)
            ‘হে আমার পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে জবাই করছি (আমি তোমাকে আল্লাহর জন্য কুরবানী করছি)। তাহলে, তুমি কি মনে কর!’ ধৈর্যশীল ছেলেটি সাথে সাথেই জবাব দিল, ‘সে বলল, হে আমার পিতা! আপনাকে যে আদেশ করা হয়েছে, আপনি তা-ই করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন। সে সবচেয়ে উত্তম জবাব দিল, এটাই ছিল তার পিতার প্রতি এবং মানব কুলের প্রভুর প্রতি বাধ্যতার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
     আল্লাহ বলেন, فَلَمَّآ أَسۡلَمَا وَتَلَّهُۥ لِلۡجَبِينِ  ‘তারপর তারা উভয়ে নিজেদেরকে (আল্লাহর ইচ্ছার কাছে) সমর্পণ করল, এবং সে তাকে তার পার্শ্বে উপর কাত অবস্থায় শুইয়ে দিল’ এখানে বলা হয়েছে, ‘যখন তারা উভয়ে নিজেদেরকে সমর্পণ করল’- অর্থ হচ্ছে তারা দু‘জনে যখন নিজেদেরকে আল্লাহর আদেশের কাছে সমর্পণ করল। ‘এবং সে তাকে শুইয়ে দিল’- এর অর্থ হচ্ছে তিনি, তাকে ছেলেকে) মাটির দিকে মুখ করে রাখলেন। এখানে বলা হলো যে, তিনি তাকে পেছন থেকে যবেহ করতে চাইলেন, যেন তিনি যবেহ করার সময় তার মুখটা দেখতে না পান। এটা ছিল ইবনে আববাস (রা.), মুজাহিদ (রাহ.) এর মত। ‘তারা উভয়ে নিজেদের সমর্পণ করল’ এর অর্থ হচ্ছে ইব্রাহীম (আ.) বললেন, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ এবং ‘আল্লাহু আকবার’ আর ছেলেটি বলল, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ – কেননা সে মৃত্যুবরণ করতে যাচ্ছিল। আস সুদ্দী এবং অন্যান্যরা বলেন যে, ইব্রাহীম (আ.) ছেলেটির গলদেশে ছুরি চালান, কিন্তু তা তাকে কাটেনি। এটা বলা হয়ে থাকে যে, ছুরি ও তার গলার মাঝখানে একটা তামার পাত রাখা হয়েছিল ( এবং আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।) তারপর তা প্রত্যাহার করা أَنْ يَا إِبْرَاهِيمُ (104) قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا    ‘হে ইব্রাহীম! তুমি তোমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছ!’- এর অর্থ হচ্ছে উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে, তোমাকে পরীক্ষা করা হয়েছে এবং তোমার প্রভু তোমাকে যে আদেশ করেছেন, তা পালন করার ব্যাপারে তোমার ইচ্ছা ও আনুগত্য প্রমাণিত হয়েছে। তোমার পুত্রের পরিবর্তে বিকল্প কুরবানীর ব্যবস্থা করা হবে- যেমন ভাবে তুমি তোমার নিজের শরীরকে আগুনের শিখায় সমর্পণ করেছিলে এবং তোমার অতিথিদের সম্মান জানাতে তোমার সম্পদ খরচ করেছিলে, তা স্মরণ রেখে। তাই আল্লাহ বলেন,
﴿ إِنَّ هَٰذَا لَهُوَ ٱلۡبَلَٰٓؤُاْ ٱلۡمُبِينُ  ﴾ ‘নিশ্চয় এটা ছিল স্পষ্ট পরীক্ষা’- অর্থাৎ এটা যে একটা পরীক্ষা ছিল তা পুরোপুরি স্পষ্ট। নিঃসন্দেহে এখানে মূল উদ্দেশ্য যবেহ ছিল না, বরং উদ্দেশ্য ছিল পিতা-পুত্রের আনুগত্য ও তাক্বওয়ার পরীক্ষা নেওয়া। সে পরীক্ষায় উভয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন পিতার পূর্ণ প্রস্ত্ততি এবং পুত্রের স্বতঃস্ফুর্ত সম্মতি ও আনুগত্যের মাধ্যমে। ﴿ وَفَدَيۡنَٰهُ بِذِبۡحٍ عَظِيم ‘আমরা তাকে একটা বড় কুরবানী দিয়ে মুক্ত করলাম’- এর অর্থ হচ্ছে আমরা তার ছেলের মুক্তিপণের ব্যবস্থা করলাম, তার পরিবর্তে যবেহ করার জন্য বিকল্প হিসেবে । বেশিরভাগ আলিমের মতে, এটা ছিল শিং বিশিষ্ট খুব সুন্দর সাদা একাটা ভেড়া।
        ইবনে আববাস (রা.) থেকে আস-সাওরী আব্দুল্লাহ ইবনে উসমান ইবনে খাইসাম, সাঈদ ইবনে জুবায়ের বর্ণনা করেন যে, ‘এটা ছিল এমন একটা ভেড়া যা চল্লিশ বছর ধরে জান্নাতে বেড়িয়েছে।’ইবনে আববাস (রা.) থেকে এ রকম বর্ণনাও এসেছে যে, ঐ ভেড়ার শুকনো মাথাটা এখনই কা‘বা শরীফের দাদের [পানি নির্গমনের] পাইপ থেকে ঝুলে রয়েছে। কেবল এটা থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, যাকে কুরবানী করার কথা ছিল, তিনি ছিলেন ইসমাঈল (আ.)- কেননা তিনি মক্কায় বসবাস করতেন এবং আমরা এমন কখনো শুনিনি যে ইসহাক (আ.) তার ছেলেবেলায় কখনো মক্কায় এসেছিলেন, আর আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানে। (ইবনে কাসীরের আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১/১৫৭-১৫৮)।
একটি সন্দেহ দূরীকরণঃ-
       যাকে কুরবানী করার কথা ছিল তিনি ইসহাক্ব (আ.) নন; বরং তিনি ছিলেন ইসমাঈল (আ.), তার কারণগুলো উপরে বর্ণনা করা হয়েছে। ইবনে কাসীর তার তাফসীর গ্রন্থে এ সকল আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বেশ কিছু বিষয়ের উল্লেখ করেন যা নিশ্চিতভাবেই প্রমাণ করে যে, ইসমাঈল (আ.) এরই কুরবানী হওয়ার কথা ছিল। সেই বিষয়গুলো এ রকম:-
• ইসমাঈল (আ.) ছিলেন তার প্রথম সন্তান, যার ব্যপারে ইব্রাহীম (আ.) – কে সুসংবাদ দেয়া হয়েছিল। মুসলিম ও আহলে কিতাবগণের ইজমা (ঐক্যমত্য) অনুসারে তিনি হলেন ইসহাক্ব (আ.)- এর চেয়ে বড়। আহলে কিতাবগণের কিতাবসমূহে এটা বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা ইব্রাহীমকে (আ.) তার একমাত্র পুত্র কুরবানী দিতে আদেশ দিয়েছিলেন। এবং কোন কোন নথিতে আছে যে, তাকে তার প্রথম জন্ম নেয়া ছেলেকে কুরবানী দিতে বলা হয়েছিল।
• সাধারণত প্রথম ছেলে অন্যদের চেয়ে বেশী প্রিয় হয়ে থাকে, আর তাই তাকে কুরবানী করা আদেশ পরীক্ষার জন্য অধিকতর উপযোগী।
• এটা উল্লিখিত রয়েছে যে, এক ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দেয়া হয়েছিল এবং তাকেই কুরবানী করার আদেশ পরীক্ষার জন্য অধিকতর উপযোগী।
• এটা উল্লিখিত রয়েছে যে, এক ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দেয়া হয়েছিল এবং তাকেই কুরবানী করার কথা ছিল। এর পরে একই সূরায় ফেরেশতারা ইব্রাহীমের (আ.) কাছে ইসহাক্বের সুসংবাদ নিয়ে আসলেন, তারা বললেন, ﴿ قَالُوا لَا تَوْجَلْ إِنَّا نُبَشِّرُكَ بِغُلَامٍ عَلِيمٍ  ‘আমরা আপনাকে একটি পুত্রের সুসংবাদ দিচ্ছি যার অনেক জ্ঞান ও প্রজ্ঞা থাকবে।’ [সূরা হিজর: ৫৩]।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,  وَامْرَأَتُهُ قَائِمَةٌ فَضَحِكَتْ فَبَشَّرْنَاهَا بِإِسْحَاقَ وَمِنْ وَرَاءِ إِسْحَاقَ يَعْقُوب আমরা তাকে (সারাকে) ইসহাক্বের সুসংবাদ দিলাম এবং তার পরে ইয়া‘কূবের সুসংবাদ দিলাম।’ [সূরা হুদ (১১):৭১] এ আয়াতের অর্থ হচ্ছে, ইয়া‘কূব বলে একজন শিশুর জন্ম হবে তাদের (সারা এবং ইসহাক্বের) জীবদ্দশায় এবং তার থেকে অনেক বংশ বিস্তার লাভ করবে এবং এটা সঠিক শোনায় না যে, ইব্রাহীমকে সেই ইসহাক্বকেই কুরবানী করতে বলা হবে যখন তিনি ছোট ছিলেন তখন, কেননা আল্লাহ অঙ্গীকার করেছেন যে তার অনেক বংশধর থাকবে।
• ইবরাহীম (আ.) এর বয়স যখন ৮৬ বৎসর তখন ইসমাঈল বিবি হাজেরার গর্ভে এবং যখন ৯৯ তখন বিবি সারার গর্ভে ইসহাক্ব জন্মগ্রহণ করেন। ইবরাহীম (আ.) সর্বমোট ২০০ বছর বেঁচে ছিলেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, ৪/১৬, মুয়াত্তা, তাফসীরে কুরতুবী, ২/৯৮-৯৯)।
• এখানে সূরা সাফফাতে ইসমাঈলকে ধৈর্যশীল বলে বর্ণনা করা হয়েছে, যা এই পটভুমিতে যথার্থ। (তাফসীর ইবনে কাসীর, ৪/১৫) আর আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।
রাসূল (সা.) এর নবূয়্যতের সমসাময়িক সময়ের ইয়াহুদীরা জানত যে, আরব ভুমিতে একজন নবী আসছেন এবং তারা তার জন্য রীতিমত অপেক্ষা করেছিল। কিন্তু তিনি (সাঃ) যেহেতু ইসহাক্ব (আ.) থেকে বিস্তৃত বণী ইসরায়েলের বংশধারায় জন্মগ্রহণ না করে, ইসমাঈল (আ.) এর বংশধারায় জন্মগ্রহণ করলেন- তখন তারা তা সহ্য করতে পারল না।
কুরবানীর শরয়ী বিধান :-
কুরবানী বিধেয় হওয়ার ব্যাপারে সকল মুসলিম একমত। এ ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত নেই। ( মুগনী, ১৩/৩৬০; ফতহুল বারী, ১০/৩) তরে, কুরবানীর হুকুম কি? ওয়জিব না সুন্নাত ? এ বিষয়ে ইমাম ও ফকীহদের মাঝে দু‘টো মত রয়েছে।
প্রথমত মত: কুরবানী ওয়াজিব। ইমাম আওযায়ী, ইমাম লাইস, ইমাম আবু হানীফা (রাহ.) প্রমুখের মত এটাই। আর ইমাম মালেক ও ইমাম আহমাদ (রাহ.) থেকে একটি মত বর্ণিত আছে যে তারাও ওয়াজিব বলেছেন।
       .কুরবানী আদায় করা ওয়াজিব। প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থমস্তিষ্ক সম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যিলহজ্ব মাসের  ১০ তারিখ  ফজর থেকে ১২ যিলহজ্ব সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা, গরু,ছাগল,মহিষ,উট,প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সকল আসবাবপত্র কুরবানীর নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য।  আর নিসাব হল স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি, রূপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরি, টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্ত্তর ক্ষেত্রে নিসাব হল এর মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। আর সোনা বা রূপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু টকারসাথে  সোনা বা রূপা  মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায় তাহলেও তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। (তাতারখানিয়া)
দ্বিতীয় মত: কুরবানী সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। এটা অধিকাংশ উলামাদের মত। এবং ইমাম মালেক ও শাফেয়ী (রাহ.) এর প্রসিদ্ধ মত। কিন্তু এ মতের প্রবক্তারা আবার বলেছেন, ‘সামর্থ্য থাকা অবস্থায় কুরবানী পরিত্যাগ করা মাকরূহ। যদি কোন জনপদের লোকেরা সমর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সম্মিলিতভবে কুরবানী পরিত্যাগ করে তবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে। কেননা, কুরবানী হলো ইসলামের একটি শিয়ার বা মহান নিদর্শন।(মহাম্মদ বিন উসাইমীন, আহকামুল উযহিয়্যাহ, পৃ. ২৬)
যারা কুরবানী ওয়াজিব বলেন তাদের দলিল:-
০১. আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিয়েছেন- ﴿ فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَٱنۡحَرۡ ﴾
 ‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও পশু কুরবানী কর ।’ [সূরা কাওসার :২]
আর আল্লাহ রাববুল ‘আলামিনের নির্দেশ পালন ওয়াজিব হয়ে থাকে।
০২. রাসূলে কারীম (সা.) বলেছেন,  مَنْ وَجَد سَعَةً فلم يُضَحِّ فلا يَقْرَبَنَّ مُصَلاَّنا‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারে না আসে।’ (মুসনাদ আহমাদ, ২/৩২১; হাকেম, ২/৩৮৯; ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ৩১২৩; হাদিসটি হাসান)
যারা কুরবানী পরিত্যাগ করে তাদের প্রতি এ হাদিস একটি সতর্কবাণী। তাই কুরবানী ওয়াজিব।
০৩. রাসূলে কারীম (সা.) কলেছেন- ياأيها الناس :إن على كل أهل بيت في كل عام أضحية ‘হে মানব সকল! প্রত্যেক পরিবারের দায়িত্ব হলো প্রতি বছর কুরবানী দেয়া। (মুসনাদ আহমাদ, ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ৩১২৫; হাদিসটি হাসান)
যারা কুরবানী সুন্নাত বলেন তাদের দলিল:
১. রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-
عن أم سلمة رضي الله عنها أن النبي صلى الله عليه وآله وسلم قال: إِذَا دَخَلَتِ الْعَشْرُ، وَأَرَادَ أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّيَ، فَلَا يَمَسَّ مِنْ شَعَرِهِ وَبَشَرِهِ شَيْئًا
অর্থঃ-হযরত উম্মে সালমা (রা.)থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী করিম (সা.)বলেন,  যখন জিলহজ মাসের প্রথম দশদিন আসে(জিলহজের চাঁদ দেখে যে ব্যক্তি কোরবানির ইচ্ছা করে, সে যতক্ষণ কোরবানি না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত যেন চুল বা নখ না কাটে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৯৭৭)
     এ হাদিসে রাসূল (সা.) এর ‘যে কুরবানী করতে চায়’ কথা দ্বারা বুঝা যায় এটা ওয়াজিব নয়।
২. রাসূল (সা.) তার উম্মতের মাঝে যারা কুরবানী করেনি তাদের পক্ষ থেকে কুরবানী করেছেন। তার এ কাজ দ্বারা বুঝে নেয়া যায় যে, কুরবানী ওয়াজিব নয়।
       আমরা মনেকরি ওয়াজিব হওয়ার দলিলগুলো বেশী শক্তিশালী। আর দলিল থেকে সুন্নাত হওয়ার ইসতিম্বাত দূর্বল।
কুরবানী শরীয়ত সম্মত হওয়ার দলীল:
ইবনু কুদামা (রহঃ) আল মুগনী গ্রন্থে (৯/৩৪) বলেন: “ইসলামী শরীয়তে কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার মাধ্যমে কুরবানীর বিধান সাব্যস্ত হয়েছে।”
কুরআন থেকে দলীল: আল্লাহ তায়ালার বাণী:-
﴿فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ﴾ “অতএব, আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামায আদায় করুন এবং কুরবানী করুন।” (সূরা কাওসারঃ ২)
কোন কোন তাফসীর কারকের মতে, এ আয়াত দ্বারা ঈদের নামাযের পর কুরবানী করা উদ্দেশ্য।
(ফিককহুল উযহিয়্যাহ)
অনুরূপভাবে কুরবানীর সপক্ষে নিন্মোক্ত আয়াতটি বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন:﴿وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآَخِرِينَ﴾ “আমি এটা (তাঁর আদর্শ) পরবর্তীদের মধ্যে রেখেছি।” (আছ ছাফ্ফাতঃ ১০৮) অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা পশু কুরবানীর বিধানটি ইবরাহীম (আঃ) এর পরবর্তী মানুষের জন্য রেখে দিয়েছেন।
সুন্নাহ (হাদীছ) থেকে দলীল:
 হযরত আনাস (রা:) বর্ণনা করেন:
ضَحَّى النبيُّ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ بكَبْشينِ أمْلَحَيْنِ أقْرَنَيْنِ، ذَبَحَهُما بيَدِهِ، وسَمَّى وكَبَّرَ، ووَضَعَ رِجْلَهُ علَى صِفَاحِهِمَا
   অর্থাৎ“নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাদা-কালো রং মিশ্রিত দুটি শিং ওয়ালা ভেড়া কুরবানী কিরে ছিলেন। নিজ হাতে উভয়টিকে যবেহ করে ছিলেন এবং যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম এবং তাকবীর বলেছিলেন তথা বিসমিল্লাহে আল্লাহু আকবার বলে যবেহ করেছিলেন। এবং (যবেহ করার সময়) তিনি ঐ পশুদ্বয়ের কাঁধে পা রেখেছিলেন।” (বুখারী ও মুসলিম)
ইজমাঃ কুরবানী শরীয়ত সম্মত হওয়ার ক্ষেত্রে মুসলিমগণ সকলে ঐকমত্য পোষণ করেছেন।
কুরবানীর ফযীলতঃ-
কুরবানী হুকম ওয়াজিব তবুও এ অনেক ফজিলত রয়েছে- কুরবানীর ফযীলত সংক্রান্ত দুটি হাদীসঃ-
عَنْ عَائِشَةَ، أَنَّ النَّبِيَّ ـ صلى الله عليه وسلم ـ قَالَ ‏ “‏ مَا عَمِلَ ابْنُ آدَمَ يَوْمَ النَّحْرِ عَمَلاً أَحَبَّ إِلَى اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ مِنْ هِرَاقَةِ دَمٍ وَإِنَّهُ لَيَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِقُرُونِهَا وَأَظْلاَفِهَا وَأَشْعَارِهَا وَإِنَّ الدَّمَ لَيَقَعُ مِنَ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ بِمَكَانٍ قَبْلَ أَنْ يَقَعَ عَلَى الأَرْضِ فَطِيبُوا بِهَا نَفْسًا
 অর্থাৎ “আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “কুরবানীর দিনে কোন আদম সন্তান কুরবানীর পশুর খুন ঝরানোর চেয়ে মহান আল্লাহর নিকট অধিক পছন্দনীয় আমল করেনা। সে কিয়ামত দিবসে উক্ত পশুর শিং, খুর, লোম প্রভৃতি নিয়ে উপস্থিত হবে। এবং তার খুন জমিনে পড়ার পূর্বেই আল্লাহর নির্ধারিত মর্যাদার স্থানে পতিত হয়। অতএব, তোমরা প্রফুল্ল চিত্তে কুরবানীকর।” (ইবনু মাজাহ, হা/৩১২৬, তিরমিযী, হা/১৪৯৩, হাকেম৪ /২২১-২২২ দ্রঃ ফিকহুল উযহিয়্যাহঃ)
 عَنْ زَيْدِ بْنِ أَرْقَمَ، قَالَ قَالَ أَصْحَابُ رَسُولِ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا هَذِهِ الأَضَاحِيُّ قَالَ ‏”‏ سُنَّةُ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ ‏”‏ ‏.‏ قَالُوا فَمَا لَنَا فِيهَا يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ ‏”‏ بِكُلِّ شَعَرَةٍ حَسَنَةٌ ‏”‏ ‏.‏ قَالُوا فَالصُّوفُ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ ‏”‏ بِكُلِّ شَعَرَةٍ مِنَ الصُّوفِ حَسَنَةٌ ‏”‏ ‏.‏
অর্থ:-“যায়েদ বিন আরকাম (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ছাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন: হে আল্লাহর রাসূল! এই কুরবানীর পশুগুলির তাৎপর্য কি? (কেন আমরা এগুলো যবেহ করে থাকি?) তিনি বললেন:“ইহা তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আঃ) এর সুন্নত।” তাঁরা জিজ্ঞাসা করলেন, এতে আমাদের কী সওয়াব রয়েছে? তিনি (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “প্রত্যেকটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকী রয়েছে।” তাঁরা জিজ্ঞাসা করলেন, পশমের মধ্যে যে ছোট ছোট লোম রয়েছে ওগুলোরও কি বিনিময় তাই? নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)বললেন, “ছোট ছোট প্রতিটি লোমের বিনিময়ে একটি করে নেকী রয়েছে।”(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৩১২৭)
কুরবানীর গুরুত্ব
নিঃসন্দেহে কুরবানী একটি ইবাদত এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন কারা যায়। এবং তাতে ইবরাহীম (আঃ) এর সুন্নাত আদায় করা হয়। সেই সাথে আমাদের প্রিয় নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নতও প্রতিপালিত হয়। কারণ, এ কুরবানী স্বয়ং নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দিয়েছেন। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
 مَنْ وَجَد سَعَةً فلم يُضَحِّ فلا يَقْرَبَنَّ مُصَلاَّنا
অর্থ: “কুরবানী দেয়ার সমর্থ থাকার পরও যে ব্যক্তি কুরবানী দেয় না সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটে না আসে।” (আহমাদ, ইবনু মাজাহ্)
কুরবানী বিশুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলি:-
কুরবানী করা আল্লাহর এক ইবাদত। আর কিতাব ও সুন্নাহ দ্বারা এ কথা প্রমাণিত যে, কোন আমল নেক, সালেহ বা ভাল হয় না, কিংবা গৃহীত ও নৈকট্যদানকারী হয় না; যতক্ষণ না তাতে প্রাথমিকভাবে ( যা অন্তরের সাথে সম্পৃক্ত) দু‘টি শর্ত পূরণ হয়েছে:
প্রথমত: ‘ইখলাস’, অর্থাৎ তা যেন খাটি আল্লাহরই উদ্দেশ্যে হয়। তা না হলে তা আল্লাহর নিকটে কবূল হবে না। যেমন কাবীলের নিকট থেকে কুরবানী কবুল করা হয়নি এবং তার কারণ স্বরূপ হাবীল বলেছিলেন,
إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ ٱللَّهُ مِنَ ٱلۡمُتَّقِينَ  অর্থাৎ ‘আল্লাহ তো মুত্তাক্বী (পরহেযগার ও সংযমী)দের কুরবানীই কবূল করে থাকেন। [ সূরা মায়িদা (৫):২৭]।
এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,
لَن يَنَالَ ٱللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلَٰكِن يَنَالُهُ ٱلتَّقۡوَىٰ مِنكُمۡۚ كَذَٰلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمۡ لِتُكَبِّرُواْ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَىٰكُمۡۗ وَبَشِّرِ ٱلۡمُحۡسِنِينَ
 অর্থাৎ, ‘আল্লাহর কাছে ওগুলোর (কুরবানীর পশুর) না গোশত পৌঁছে, আর না রক্ত পৌঁছে বরং তার কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি ওগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে পার এজন্য যে, তিনি তোমাদেরকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন, কাজেই সৎকর্মশীলদেরকে তুমি সুসংবাদ দাও। [সূরা হাজ্জ (২২):৩৭]
দ্বিতীয়ত : তা যেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর নির্দেশিত বিধি-বিধান অনুযায়ী হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَمَنْ كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا – অর্থাৎ, ‘যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরীক না করে। (সূরা কাহফ:১১০)।
সুতরাং যারা কেবল বেশী করে গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্যে কুরবানী দেয় অথবা লোক সমাজে নাম কুড়াবার উদ্দেশ্যে মোটা-তাজা অতিরিক্ত মূল্যের পশু ক্রয় করে এবং তা প্রদর্শন ও প্রচার করে থাকে তাদের কুরবানী যে ইবাদত নয়- তা বলাই বাহুল্য।
পশু যবেহ করার সুন্নত পদ্ধতিঃ-
                   যবেহ করার সুন্নাত তরীকা এই যে, যবেহ করার পূর্বে ছুরি উত্তম ভাবে ধার/তেজ করে নিবে এবং যবেহকারী কিবলামূখী হয়ে দাঁড়াবে এবং যবেহের জন্য পশু কেবলামূখী করে শুয়াবে এবং নিচের আয়াত শরীফ পাঠ করবে-
اِنِّىْ وَجَّهْتُ وَجْهِىَ لِلَّذِىْ فَطَرَ السَّموَاتِ وَالْاَرْضَ حَنِيْفًا وَّمَا اَنَا مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ- اِنَّ صَلَاتِىْ وَنُسُكِىْ وَمَحْيَاىَ وَ مَمَاتِىْ للهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ- لَاشَرِيْكَ لَه وَ بِذَا لِكَ اُمِرْتُ وَاَنَا اَوَّلُ الْمُسْلِمِيْنَ- اَللّهُمَّ لَكَ وَ مِنْكَ
   অর্থাৎ “আমি সকল দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে একনিষ্ঠ হয়ে ঐ আল্লাহর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করর্ছি যিনি আসমান যমীন সৃষ্টি করেছেন এবং আমি কখনো শিরক কারীদের মধ্যে নই। নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার কুরবানী আমার জীবন ও আমার মরণ সব কিছুই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্যে। তার কোন শরীক নেই, আমাকে তারই নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং আমি সকলের আগে তার অনুগত ও ফরমাবরদার। হে আল্লাহ! এ তোমারই জন্যে পেশ করা হচ্ছে এবং এ তোমারই দেয়া”। { মিশকাতুল মাসাবীহ্ }
       তারপর بسم الله الله اكبر  বলে যবেহের কার্য্য সমাধা করবে এবং যবেহ করার পর নিচের  দোয়া পাঠ করবে।
اَللّهُمَّ تَقَبَّلْ مِنِّى كَمَا تَقَبَّلْتَ مِنْ حَبِـيْبِكَ مُحَمَّدٍ وَخَلِيْلِكَ اِبْرَاهِيْمَ عَلَيْهِمَا السَّلَامُ-
 অর্থাৎ “হে আল্লাহ! তুমি এ কুরবানী আমার পক্ষ থেকে কবুল কর, যেমন তুমি তোমার পিয়ারা হাবীব মুহাম্মদ সা. এবং তোমার খলীল ইবরাহীম আ. এর কুরবানী কবুল করেছিলে”।
 বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ-
     যবেহ করার সময় “বিছমিল্লাহি আল্লাহু আকবার” মুখে বলা জরুরী/ফরয। তবে শুধু দিলে দিলে কুরবানীর নিয়ত করলেই যথেষ্ট হবে।মৌখিক ভাবে বলা জরুরী নয়।যদি কেউ ইচ্ছা পূর্বক বিছমিল্লাহ না বলে, তা হলে পশু হালাল হবে না।
     যবেহকারীর সাথে যারা ছুরি বা তলোয়ার ধরবে তাদের সকলকেই “বিছমিল্লাহ” পড়তে হবে। যদি কেউ কেউ না পড়ে, তাহলে উক্ত পশুর গোশত হালাল হবে না। { ফাতওয়ায়ে শামী ও কাজী খান। }
      যবেহকারীর মুখ কেবলার দিকে হওয়া সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্। ওজর ব্যতীত বাদ দিলে মাকরূহ হবে।
যবেহের শরীয়ত সম্মত নিয়ম হলো : শ্বাসনালী, খাদ্য নালী ও তার দুই পার্শ্বে দুইটি রক্তের মোটা রগ এই চারটি জিনিস কাটা। কমপক্ষে তিনটি কাটলে খাওয়া হালাল হবে, নতুবা হারাম হবে। উক্ত চার রগের পর সম্পূর্ণ গলা কর্তন করা মাকরূহ। { ফাতওয়ায়ে শামী। }
কুরবানীর কতিপয় মাসায়েল:-
মাসআলা :-১. কুরবানীর নেসাব পুরো বছর মালিকানায় থাকা জরুরি নয়; বরং কুরবানীর তিন দিনের মধ্যে যে কোনো দিন থাকলেই কুরবানী ওয়াজিব হবে।(রদ্দুল মুহতার)
মাসআলা : -২. মোট তিনদিন কুরবানী করা যায়। যিলহজ্বের ১০, ১১ ও ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত। তবে সম্ভব হলে যিলহজ্বের ১০ তারিখেই কুরবানী করা উত্তম। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া )
মাসআলা :- ৩. নাবালেগ শিশু-কিশোর এবং সুস্থমস্তিষ্কসম্পন্ন নয়, নেসাবের মালিক হলেও তাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। অবশ্য তার অভিভাবক নিজ সম্পদ দ্বারা তাদের পক্ষে কুরবানী করলে তা সহীহ হবে।(রদ্দুল মুহতার)
মাসআলা : -৪.  যে ব্যক্তি কুরবানীর দিনগুলোতে মুসাফির থাকবে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। (দুররুল মুখতার)
মাসআলা : -৫. দরিদ্র ব্যক্তির উপর কুরবানী করা ওয়াজিব নয়; কিন্তু সে যদি কুরবানীর নিয়তে কোনো পশু কিনে তাহলে তা কুরবানী করা ওয়াজিব হয়ে যায়।
মাসআলা : ৬. কেউ যদি কুরবানীর দিনগুলোতে ওয়াজিব কুরবানী দিতে না পারে তাহলে কুরবানীর পশু ক্রয় না করে থাকলে তার উপর কুরবানীর উপযুক্ত একটি ছাগলের মূল্য সদকা করা ওয়াজিব। আর যদি পশু ক্রয় করে ছিল, কিন্তু কোনো কারণে কুরবানী দেওয়া হয়নি তাহলে ঐ পশু জীবিত সদকা করে দিবে। (ফাতাওয়া কাযীখান)
মাসআলা:-৭ জিলহজ্ব মাসের ১১ ও ১২ তারিখ: রাতেও কুরবানী করা জায়েয। তবে দিনে কুরবানী করাই ভালো। (আহমাদ, হাদীস)
মাসআলা : -৮. কুরবানীর দিনগুলোতে যদি জবাই করতে না পারে তাহলে খরিদকৃত পশুই সদকা করে দিতে হবে। তবে যদি (সময়ের পরে) জবাই করে ফেলে তাহলে পুরো গোশত সদকা করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে গোশতের মূল্য যদি জীবিত পশুর চেয়ে কমে যায় তাহলে যে পরিমাণ মূল্য হ্রাস পেল তা-ও সদকা করতে হবে।(দুররুল মুখতার)
মাসআলা : -০৯.  গৃহপালিত উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কুরবানী করা জায়েয। এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু যেমন হরিণ, বন্যগরু,বন-মহিষ ইত্যাদি দ্বারা কুরবানী করা জায়েয নয়।(কাযীখান)
মাসআলা : -১০. উট কমপক্ষে ৫ বছরের হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে ২ বছরের হতে হবে। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে ১ বছরের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি ১ বছরের কিছু কমও হয়, কিন্তু এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে, দেখতে ১ বছরের মতো মনে হয় তাহলে তা দ্বারাও কুরবানী করা জায়েয। অবশ্য এক্ষেত্রে কমপক্ষে ৬ মাস বয়সের হতে হবে।  উল্লেখ্য, ছাগলের বয়স ১ বছরের কম হলে কোনো অবস্থাতেই তা দ্বারা কুরবানী জায়েয হবে না। (কাযীখান)হাদিসে এসেছে-
لَا تَذْبَحُوا إلَّا مُسِنَّةً إلَّا أَنْ يَعْسُرَ عَلَيْكُمْ فَتَذْبَحُوا جَذَعَةً مِنْ الضَّأْنِ
‘তোমরা অবশ্যই নির্দিষ্ট বয়সের পশু কুরবানী করবে। তবে তা তোমাদের জন্য দুষ্কর হলে ছয় মাসের মেষ-শাবক কুরবানী করতে পার।’ [মুসলিম, হাদীস নং ১৯৬৩]।
মাসআলা :-১১. একটি ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা দ্বারা শুধু একজনই কুরবানী দিতে পারবে। এমন একটি পশু কয়েকজন মিলে কুরবানী করলে কারোটাই সহীহ হবে না। আর উট, গরু, মহিষে সর্বোচ্চ সাত জন শরীক হতে পারবে। সাতের অধিক শরীক হলে কারো কুরবানী সহীহ হবে না। ( মুয়াত্তা মালেক)
মাসআলা :-১২. সাতজনে মিলে কুরবানী করলে সবার অংশ সমান হতে হবে। কারো অংশ এক সপ্তমাংশের কম হতে পারবে না। যেমন কারো আধা ভাগ, কারো দেড় ভাগ। এমন হলে কোনো শরীকের কুরবানীই সহীহ হবে না।
মাসআলা :-১৩. উট, গরু, মহিষ সাত ভাগে এবং সাতের কমে যেকোনো সংখ্যা যেমন দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগে কুরবানী করা জায়েয। (সহীহ মুসলিম )
মাসআলা :-১৪. যদি কেউ আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে কুরবানী না করে শুধু গোশত খাওয়ার নিয়তে কুরবানী করে তাহলে তার কুরবানী সহীহ হবে না। তাকে অংশীদার বানালে শরীকদের কারো কুরবানী হবে না। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে শরীক নির্বাচন করতে হবে। (কাযীখান)
মাসআলা :-১৫:ওয়াজিব কুরবানীর গরু, মহিষ ও উটে আকীকার নিয়তে শরীক হতে পারবে। এতে কুরবানী ও আকীকা দুটোই সহীহ হবে। যেমন একটি গরু/মহিষের মধ্যে ৫/৬ শরীক আছে বাকী ১/২ ভাগে আর কেউ আকীকার নিয়তে অংশীদার হলে জায়িয হবে। উল্লেখ্য যে, আকীকার জন্য ছেলের ক্ষেত্রে ২ ভাগ আর কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে ১ ভাগে অংশীদার হতে হবে। অনুরূপভাবে নফল, নজর, মান্নত ও ওছিয়তের অংশ নিলেও জায়িয হবে।(ফাতওয়ায়ে শামী)
মাসআলা :- ১৬.শরীকদের কারো পুরো বা অধিকাংশ উপার্জন যদি হারাম হয় তাহলে কারো কুরবানী সহীহ হবে না।
মাসআলা :-১৭. যদি কেউ গরু, মহিষ বা উট একা কুরবানী দেওয়ার নিয়তে কিনে আর সে ধনী হয় তাহলে ইচ্ছা করলে অন্যকে শরীক করতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে একা কুরবানী করাই শ্রেয়। শরীক করলে সে টাকা সদকা করে দেওয়া উত্তম। আর যদি ওই ব্যক্তি এমন গরীব হয়, যার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব নয়, তাহলে সে অন্যকে শরীক করতে পারবে না। এমন গরীব ব্যক্তি যদি কাউকে শরীক করতে চায় তাহলে পশু ক্রয়ের সময়ই নিয়ত করে নিবে।(কাযীখান)
মাসআলা :-১৮.যে পশু তিন পায়ে চলে, এক পা মাটিতে রাখতে পারে না বা ভর করতে পারে না এমন পশুর কুরবানী জায়েয নয়। (জামে তিরমিযী)
মাসআলা :-১৯. এমন শুকনো দুর্বল পশু, যা জবাইয়ের স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না তা দ্বারা কুরবানী করা জায়েয নয়।(জামে তিরমিযী)
মাসআলা :- ২০. যে পশুর একটি দাঁতও নেই বা এত বেশি দাঁত পড়ে গেছে যে, ঘাস বা খাদ্য চিবাতে পারে না এমন পশু দ্বারাও কুরবানী করা জায়েয নয়।( আলমগীরী)
মাসআলা :- ২১. যে পশুর শিং একেবারে গোড়া থেকে ভেঙ্গে গেছে, যে কারণে  মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে পশুর কুরবানী জায়েয নয়। পক্ষান্তরে যে পশুর অর্ধেক শিং বা কিছু শিং ফেটে বা ভেঙ্গে গেছে বা শিং একেবারে উঠেইনি সে পশু কুরবানী করা জায়েয। (জামে তিরমিযী)
মাসআলা :- ২২. যে পশুর লেজ বা কোনো কান অর্ধেক বা তারও বেশি কাটা সে পশুর কুরবানী জায়েয নয়। আর যদি অর্ধেকের বেশি থাকে তাহলে তার কুরবানী জায়েয। তবে জন্মগতভাবেই যদি কান ছোট হয় তাহলে অসুবিধা নেই। ( মুসনাদে আহমদ)
মাসআলা :-২৩. যে পশুর দুটি চোখই অন্ধ বা এক চোখ পুরো নষ্ট সে পশু কুরবানী করা জায়েয নয়। (কাযীখান / আলমগীরী )
মাসআলা :-২৪. কুরবানীর পশু হারিয়ে যাওয়ার পরে যদি আরেকটি কেনা হয় এবং পরে হারানোটিও পাওয়া যায় তাহলে কুরবানীদাতা গরীব হলে (যার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়) দুটি পশুই কুরবানী করা ওয়াজিব। আর ধনী হলে কোনো একটি কুরবানী করলেই হবে। তবে দুটি কুরবানী করাই উত্তম। (সুনানে বায়হাকী)
মাসআলা :-২৫. গর্ভবতী পশু কুরবানী করা জায়েয। জবাইয়ের পর যদি বাচ্চা জীবিত পাওয়া যায় তাহলে সেটাও জবাই করতে হবে। তবে প্রসবের সময় আসন্ন হলে সে পশু কুরবানী করা মাকরূহ। (কাযীখান)
মাসআলা :-২৬. বন্ধ্যা পশুর কুরবানী জায়েয। (রদ্দুল মুহতার)
মাসআলা :- ২৭. কুরবানীর পশু নিজে জবাই করা উত্তম। নিজে না পারলে অন্যকে দিয়েও জবাই করাতে পারবে। এক্ষেত্রে কুরবানীদাতা পুরুষ হলে জবাইস্থলে তার উপস্থিত থাকা ভালো। (মুসনাদে )
মাসআলা :-২৮. অনেক সময় জবাইকারীর জবাই সম্পন্ন হয় না, তখন কসাই বা অন্য কেউ জবাই সম্পন্ন করে থাকে। এক্ষেত্রে অবশ্যই উভয়কেই নিজ নিজ যবাইয়ের আগে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ পড়তে হবে। যদি কোনো একজন না পড়ে তবে ওই কুরবানী সহীহ হবে না এবং জবাইকৃত পশুও হালাল হবে না। (রদ্দুল মাহতার)
মাসআলা :-২৯. কয়েকজন মিলে কুরবানী করার ক্ষেত্রে জবাইয়ের আগে কোনো শরীকের মৃত্যু হলে তার ওয়ারিসরা যদি মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানী করার অনুমতি দেয় তবে তা জায়েয হবে। নতুবা ওই শরীকের টাকা ফেরত দিতে হবে। অবশ্য তার  স্থলে অন্যকে শরীক করা যাবে। ( কাযীখান)
মাসআলা :-৩০. মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানী করা জায়েয। মৃত ব্যক্তি যদি ওসিয়ত না করে থাকে তবে সেটি নফল কুরবানী হিসেবে গণ্য হবে। কুরবানীর স্বাভাবিক গোশতের মতো তা নিজেরাও খেতে পারবে এবং আত্মীয়-স্বজনকেও দিতে পারবে। আর যদি মৃত ব্যক্তি কুরবানীর ওসিয়ত করে গিয়ে থাকে তবে এর গোশত নিজেরা খেতে পারবে না। গরীব-মিসকীনদের মাঝে সদকা করে দিতে হবে। (মুসনাদে আহমদ)
মাসআলা :- ৩১. কুরবানীর গোশত তিনদিনেরও অধিক জমিয়ে রেখে খাওয়া জায়েয।(সহীহ মুসলিম)
মাসআলা :-৩২. শরীকে কুরবানী করলে ওজন করে গোশত বণ্টন করতে হবে। অনুমান করে ভাগ করা জায়েয নয়। যত শরীকে কুরবানী হবে ভাগও ততটি হবে, কোন কোন এলাকায় একভাগ বেশী করা হয় যেমন সাত শরীকে কুরবানী দিয়ে আটভাগ করে ৮ম ভাগ দরিদ্রদের মধ্যে বন্টন করা হয়। এরূপ করা বৈধ হবেনা।
মাসআলা :-৩৩.কুরবানীর গোশতের এক তৃতীয়াংশ গরীব-মিসকীন ও পাড়াপ্রতিবেশী এবং এক তৃতীয়াংশ আত্মীয়-স্বজনকে দেওয়া উত্তম।
মাসআলা :-৩৪.জবাইকারী, কসাই বা কাজে সহযোগিতাকারীকে চামড়া, গোশত বা কুরবানীর পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া জায়েয হবে না। অবশ্য পূর্ণ পারিশ্রমিক দেওয়ার পর পূর্বচুক্তি ছাড়া হাদিয়া হিসাবে দেওয়া যাবে।
মাসআলা :-৩৫.যেসকল হাজী কুরবানীর দিনগুলোতে মুসাফির থাকবে তাদের উপর ঈদুল আযহার কুরবানী ওয়াজিব নয়।কিন্তু যে হাজী কুরবানীর কোনো দিন মুকীম থাকবে সামর্থ্যবান হলে তার উপর ঈদুল আযহার কুরবানী করা জরুরি হবে। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া)
মাসআলা :-৩৬. সামর্থ্যবান ব্যক্তির রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে কুরবানী করা উত্তম। এটি বড় সৌভাগ্যের বিষয়ও বটে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলীকে (রাঃ) তার পক্ষ থেকে কুরবানী করার ওসিয়্যত করেছিলেন। তাই তিনি প্রতি বছর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকেও কুরবানী দিতেন। (সুনানে আবু দাউদ)
মাসআলা :-৩৭. বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তির জন্য নিজ দেশে বা অন্য কোথাও কুরবানী করা জায়েয।
মাসআলা :- ৩৮. কুরবানীদাতা এক স্থানে আর কুরবানীর পশু ভিন্ন স্থানে থাকলে কুরবানীদাতার ঈদের নামায পড়া বা না পড়া ধর্তব্য নয়; বরং পশু যে এলাকায় আছে ওই এলাকায় ঈদের জামাত হয়ে গেলে পশু জবাই করা যাবে। (দুররুল মুখতার )
মাসআলা :- ৩০.কুরবানীর চামড়া কুরবানীদাতা নিজেও ব্যবহার করতে পারবে। তবে কেউ যদি নিজে ব্যবহার না করে বিক্রি করে তবে বিক্রিলব্ধ মূল্য পুরোটা সদকা করা জরুরি। (আদ্দুররুল মুখতার )
মাসআলা :-৪০.ঈদুল আযহার দিন সর্বপ্রথম নিজ কুরবানীর গোশত দিয়ে খানা শুরু করা সুন্নত। অর্থাৎ সকাল থেকে কিছু না খেয়ে প্রথমে কুরবানীর গোশত খাওয়া সুন্নত।তবে অবশ্যই সূর্যাস্তের পূর্বে খানা খেতে হবে। কেননা ঐদিন রোজা রাখা হারাম। এই সুন্নত শুধু ১০ যিলহজ্বের জন্য। ১১ বা ১২ তারিখের গোশত দিয়ে খানা শুরু করা সুন্নত নয়। (জামে তিরমিযী)
মাসআলা :-৪১.কুরবানীর মৌসুমে অনেক মহাজন কুরবানীর হাড় ক্রয় করে থাকে। টোকাইরা বাড়ি বাড়ি থেকে হাড় সংগ্রহ করে তাদের কাছে বিক্রি করে। এদের ক্রয়-বিক্রয় জায়েয। এতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু কোনো কুরবানীদাতার জন্য নিজ কুরবানীর কোনো কিছু এমনকি হাড়ও বিক্রি করা জায়েয হবে না।
মাসআলা :- ৪২.প্রত্যেক হালাল পশুর ৭টি অংশ ব্যতীত সবটুকুই খাওয়া হালাল । কেবল সাতটি জিনিস খাওয়া যাবে না। সাতটির মধ্যে একটি হারাম এবং ছয়টি মাকরূহ তাহরীমী।
১. প্রবাহিত রক্ত যা যবেহের পর রগ থেকে স্ববেগে বের হয়, তা হারাম।
২. পুরুষ পশুর পুরুষ অঙ্গ।
৩. মহিলা পশুর পেশাবের স্থান/স্ত্রী অঙ্গ।
৪. অন্ডকোষ।
৫. পেশাবের ঝুলি।
৬. পীতের থলে।
৭. মাংসের গ্রন্থি, যা অধিকাংশ সময় চামড়া ও গোশতের মধ্যবর্তী স্থানে হয়ে থাকে। অর্থাৎ গোশতের উপরিভাগে এবং চামড়ার নিম্ন ভাগের গুটি।
মাসআলা :-৪৩. বিছমিল্লাহ পড়ার পর যদি জানোয়ার পালিয়ে যায়, তবে দ্বিতীয় বার যবেহ করার সময় আবার  বিছমিল্লাহ পড়া ওয়াজিব।
মাসআলা :- ৪৪.ভাল জানোয়ার কুরবানী করার সময় যদি ক্রটিময় হয় যেমন, পা ভেঙ্গে গেল, তা সত্ত্বেও কুরবানী সহীহ হবে।  {ফাতওযায়ে শামী ৫ম খন্ড ২৮৪ পৃষ্ঠা।}
মাসআলা :-৪৫. কুরবানকারীর জন্যে এটা উত্তম যে, যে দিন কুরবানীর পশু যবেহ করা হবে তার কিছু দিন পূর্বেই কুরবানীর পশু সংগ্রহ করে তাকে লালন-পালন করবে। কেননা আল কুরআনে কুরবানীকে সম্মান করার ঘোষণা এসেছে :
وَ مَنْ يُّعَظِّمْ شَعَا ئِرَاللهِ فَاِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوْبِ –   অর্থাৎ “কেউ আল্লাহর নাম যুক্ত বস্তু সমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলে তা তো তার হৃদয়ের আল্লাহ ভীতি প্রসূত”। { সূরা আল হজ্জ -৩২। }
মাসআলা :-৪৬. জানোয়ারের প্রাণ পূর্ণভাবে বের হয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত জানোয়ার ঠান্ডা না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত চামড়া না খোলা এবং গোশ্তের কোন অংশ না কাটা উচিৎ। কারণ, এতে জানোয়ারের কষ্ট হয়। { রদ্দুল মোখতার)
মাসআলা :-৪৭. বৎসরের অন্যান্য মাসের মত যিলহজ্জ মাসেরও চাঁদ উদয় হওয়ার পর থেকে দশ তারিখের মধ্যে যে কোন দিন গরু, ছাগল, মুরগী ইত্যাদি যবেহ করা জায়িয, এতে দোষের কিছু নেই।
মাসআলা : -৪৮.কুরবানীর দিনগুলিতে যে সমস্ত পশু দ্বারা কুরবানী জায়েয নেই, তা কুরবানীর নিয়তে যবেহ করা মাকরূহ। (যেমন হাঁস, মুরগী ইত্যাদি)। { ফাতওয়ায়ে আলমগীরী। }
মাসআলা : -৪৯.কুরবানীর নিয়তে পশু ক্রয় করে তার দ্বারা উপকৃত হওয়া মাকরূহ। যেমন সওয়ার হওয়া, কাজ করানো, দুধ দোহানো, পশম কাটা, ভাড়া দেয়া ইত্যাদি। যদি এরকম করা হয়, তবে এর লাভের পরিমাণের টাকা সদকা করা ওয়াজিব।
মাসআলা :-৫০. সম্পত্তির কয়েকজন অংশীদার একই পরিবার ভূক্ত হলে, যদি তাদের মাল পৃথক করলে প্রত্যেকের উপর কুরবানী করা ওয়াজিব হওয়ার পরিমাণ মাল হয়, তাহলে প্রত্যেকেই পৃথক পৃথক ভাবে কুরবানী করতে হবে। এরূপ একান্নভূক্ত পরিবারের একাধিক ব্যক্তি মিলে কুরবানী দিলে, সে ক্ষেত্রে কুরবানীর গোশত বন্টন করা জরুরী নয়। একত্রে রেখে সকলে খেতে পারবে। [ফাতওয়ায়ে শামী ৬ষ্ঠ খন্ড।
মাসআলা :- ৫১.কারো কুরবানী ওয়াজিব না হলে ও কিংবা কেউ ঋণী হলে ও শরীয়তে তার কুরবানী করার অনুমতি আছে এবং এটা বিরাট ছওয়াবের কাজ। আর ওয়াজিব হলে তো কুরবানী দিতেই হবে। কোন প্রকার ঋণ কুরবানী সহীহ হয়োর জন্য প্রতিবন্ধক নয়। [সুনানে তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মিশকাত, ফাতওয়ায়ে আলমগীরী ৫ম খন্ড ২৯১পৃষ্ঠা।]
মাসআলা :-৫২. কেউ কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার পর ৭/৮ বছর কুরবানী করেনি। এখন বিগত বছরের কুরবানী বর্তমান বছরের কুরবানীর সাথে যোগ করে আদায় করলে তা আদায় হবে না। বরং এ বছর, শুধু এ বছরের কুরবানীই আদায় করা যাবে। আর অন্যান্য বছরের কুরবানীর কাযা হিসেবে সেগুলোর পশু ক্রয় করে সরাসরি দান করে দিতে হবে অথবা সে গুলোর মূল্য সদকা করে দিতে হবে। [দুররুল মুখতার ৫ম খন্ড ২২৬পৃ/ফাতওয়ায়ে আলমগীরী ৫ম খন্ড ২৯৬-২৯৭ পৃষ্ঠা।
মাসআলা :- ৫৩.কুরবানীর জন্তুকে ফুলের মালায় সাজিয়ে অথবা পিঠের উপর রঙ্গিন কাপড় জড়িয়ে রাস্তায়-রাস্তায়, বাড়ী-বাড়ী ঘোড়ানো, এসকল কাজ অবান্তর। এতে সাওয়াবের পরিবর্তে গুনাহ হবে। তাই এ সকল কু-সংষ্কার পরিত্যাগ করা মুসলমানদের কর্তব্য।
মাসআলা :-৫৪. কোন কোন এলাকায় কুরবানীর পশুর খাদ্যনালী, গরুর শিং ইত্যাদি নিয়ে ঘরের সামনে টাঙিয়ে রাখা হয়। মনে করা হয় এর মাধ্যে রয়েছে অনেক পূণ্য এবং এর দ্বারা কোন জ্বীন-ভূত ঢুকতে পারবে না। প্রকৃত পক্ষে এসকল কাজ শরীয়তের পরিপন্থী। ইসলামে এর কোন ভিত্তি নেই।
মাসআলা :-৫৫. কোন কোন এলাকায় যে সমস্ত গাছের আমে পোকা হয়, সে সমস্ত গাছে বসে কুরবানীর গোশ্ত খেয়ে তার হাড় গুলো গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয় এবং মনে করা হয় যে, আম গাছে আর পোকায় ধরবে না। কিন্তু এসকল কাজ বিদআত, শরীয়ত পরিপন্থী। এমন গর্হিত কাজ হতে মুসলমানদের বেঁচে থাকা উচিৎ।
     আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে ইখলাসের সাথে একমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টির লক্ষ্যে কুরবানী ও সকল ইবাদাত করার তাওফীক দান করুন— আমীন!
লেখক-
মোহাম্মদ আবদুল আজিজ মজুমদার, অধ্যক্ষ,হায়দরগঞ্জ তাহেরিয়া আর.এম.কামিল মাদরাসা। রায়পুর,লক্ষ্মীপুর।
শেয়ার করুনঃ

সাবেক জ্বালানী উপদেষ্টা তৌফিক ই ইলাহী গ্রেপ্তার

১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১১:২৮

ড. ইউনূসের সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন নেদারল্যান্ডসের

১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১১:২১

এক দশক পর দেশে ফিরছেন সাংবাদিক মুশফিক

১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১১:১৮

প্রেস কাউন্সিল চেয়ারম্যান ও সাংবাদিক কল্যাণের এমডির চুক্তি বাতিল

৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৭:০৮

ভূমি অফিসের কর্মীদের কঠোর হুঁশিয়ারি হাসনাত আব্দুল্লাহর

৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৭:০৬

রিমান্ড শেষে কারাগারে আ স ম ফিরোজ

৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৭:০২

খালেদার ১১ মামলার শুনানি ৩১ অক্টোবর

৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৬:৫৯

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ভ্যাটিকান রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ

৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৬:৩৭

বিজিবি সদস্যদের প্রতি কঠোর নির্দেশনা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার

৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১০:৫৪

বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নেতৃত্বে ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ ঘোষণা

৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১০:৫০

বিয়ের প্রলোভনে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণ, যুবক গ্রেফতার

৮ মে, ২০২১, ৪:৫৩

চেলসির সঙ্গে ড্র, ফাইনালের পথ কঠিন হলো রিয়ালের

২৮ এপ্রিল, ২০২১, ৬:৫৩

রুদ্ধশ্বাস ম্যাচে দিল্লিকে হারিয়ে শীর্ষে কোহলিরা

২৮ এপ্রিল, ২০২১, ৬:৫১

আরও ২/৩ দিন হাসপাতালে থাকতে হবে খালেদা জিয়াকে

২৮ এপ্রিল, ২০২১, ৬:৪৩

খাদ্যের সঙ্গে পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতেও কাজ হচ্ছে: প্রধানমন্ত্রী

২২ মে, ২০২১, ১০:০৭

পপ সম্রাটের বিরদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ প্রত্যাখান

২৮ এপ্রিল, ২০২১, ৬:৪০

ইউনেসকোর প্রেস ফ্রিডম পুরস্কার জিতলেন মারিয়া রেসা

২৮ এপ্রিল, ২০২১, ৬:৩৮

দিরাইয়ে বজ্রপাতে দুই সহোদরের মৃত্যু, আহত ৩

২৮ এপ্রিল, ২০২১, ৬:৩৭

রাজধানীতে অভিযানে গ্রেফতার ৩০

২৮ এপ্রিল, ২০২১, ৬:৩৬

ওবায়দুল কাদের আপনি রেহাই পাবেন না: কাদের মির্জা

২৮ এপ্রিল, ২০২১, ৬:৩৩


উপরে